সেন বংশের পতন এবং ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয়ের মাধ্যমে বাংলার রাজক্ষমতা মুসলমানদের অধিকারে আসে । ফলে বাংলায় মধ্যযুগের সূচনা ঘটে। মুসলমানদের আগমনের পূর্বে বাংলায় বাস করত হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষ । এগারো শতক থেকে বাংলায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করার জন্য সুফি সাধকগণ আসতে থাকেন । বাংলার সাধারণ হিন্দু ও বৌদ্ধদের অনেকে এ সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে । এভাবে ধীরে ধীরে বাংলায় একটি মুসলমান সমাজ কাঠামো গড়ে উঠতে থাকে । এ যুগে বাংলায় হিন্দু আর মুসলমান পাশাপাশি বাস করছিল । ফলে একে অন্যের চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণের মিশ্রণ ঘটতে থাকে । এভাবে বাংলায় যে সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল, তাকেই বলা হয় বাঙালি সংস্কৃতি ।
এই অধ্যায় শেষে আমরা-
কণিকা বড়ুয়া ও রহিমা খাতুন একই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞম শ্রেণি পাস করে। কণিকা বড়ুয়া মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হয়। কিন্তু রহিমা খাতুনের বাবা মেয়েদের মাধ্যমিক স্কুলে পড়াকে চরম অমর্যাদা মনে করেন। তাই রহিমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে বিয়ে দেন। রহিমা বিয়ের পরে সাত সন্তানের মা হয়ে শারীরিক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ভেঙে পড়ে।
নিখিল রায় পাঁচ হাজার টাকা পণ দিয়ে বিমল রায়ের ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করেন। কয়েক বছর পরে তাদের একটি সন্তান হলো এবং গঙ্গাজল দিয়ে ধৌত করে নিয়ে আসল। নিখিল রায় ও তার সম্পত্তিতে তার স্ত্রীর কোনো অধিকার ছিল না। হঠাৎ নিখিল রায় মারা গেলে তার স্ত্রীকেও একই চিতায় পোড়ানো হয়।
মধ্যযুগে বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় হিন্দু ও মুসলমান এই দুইটি ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান ছিল । বস্তুত এই দুই ধর্মকে কেন্দ্র করেই মধ্যযুগে বাংলার সামাজিক রীতি-নীতি গড়ে উঠেছিল ।
মুসলমান সমাজ ও সংস্কৃতি:
মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান শাসনকালে সুলতান ছিলেন সমাজ জীবনে সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী । মুসলমান সমাজ জীবনে সুলতানকে কতকগুলো বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হতো। জুমা এবং ঈদের নামাজে খুতবা পাঠ মুসলমান শাসকের একটি বিশেষ কর্তব্য ছিল। তাঁকে মুসলমান সমাজের নেতা হিসেবে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হতো । মুসলমানদের ঐক্য ও ধর্মীয় চেতনা প্রসারের জন্য শাসক নিজ নিজ রাজ্যে মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ্ ইত্যাদি নির্মাণ করতেন। মুসলমান শাসকরা জমকালো প্রাসাদে বাস করতেন। তাঁদের রাজধানীও নানারকম মনোমুগ্ধকর অট্টালিকায় সুসজ্জিত থাকত । ঐশ্বর্য ও আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াও রাজদরবারের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের সমাবেশ । শাসকগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির উদার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান সমাজ ব্যবস্থায় উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন – এই তিনটি পৃথক শ্রেণির অস্তিত্ব ছিল। সৈয়দ, -- উলেমা প্রমুখ শ্রেণি সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল । ধর্মপরায়ণ ও শিক্ষিত ব্যক্তিগণকে জনগণ যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত। মুসলমান শাসকগণও তাঁদের বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে ভাতা এবং জমি বরাদ্দ করা হতো। উলেমাগণ ইসলামি শিক্ষায় অভিজ্ঞ হতেন । তাঁদের মধ্য থেকে কাজি, ইমাম, মুয়াজ্জিন এবং ধর্মবিষয়ক অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ করা হতো । শেখগণ ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক বিষয়ে জনগণকে শিক্ষা দিতেন। মধ্যযুগে বাংলায় মুসলমান সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাঁদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল।
মধ্যযুগে বাংলার মুসলমান সমাজে একটি অভিজাত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল । যোগ্যতা, প্রতিভা ও জ্ঞানের দ্বারা তারা নিজেদের সাধারণ মানুষের তুলনায় একটি আলাদা শ্রেণি হিসেবে গড়ে তুলেছিল । যেকোনো ব্যক্তি তার যোগ্যতা ও প্রতিভা দ্বারা রাষ্ট্রের মর্যাদাপূর্ণ পদে বসতে পারতেন। এ ক্ষেত্রে সুলতান গিয়াসউদ্দিন ইওজ খলজি ও সুবাদার মুর্শিদ কুলি খানের দৃষ্টান্ত উল্লেখযোগ্য । অবশ্য পরবর্তী সময়ে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। উত্তরাধিকার সূত্রে মর্যাদাপূর্ণ সরকারি পদ লাভের নীতি প্রচলিত হয় । এ যুগে সামরিক ও বিচার বিভাগের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের নিয়ে সরকারি অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠেছিল। নিম্ন শ্রেণির সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয় । কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমিক শ্রেণি নিয়ে তৃতীয় শ্রেণি গঠিত ছিল। কৃষকদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু । কতকগুলো পেশা মুসলমানদের জন্য একচেটিয়া ছিল ।
মুসলমান সমাজে কতকগুলো সামাজিক উৎসব পালন করা হতো। এগুলো এখনও মুসলমানরা পালন করে । মুসলমানরা নবজাত শিশুর নামকরণকে কেন্দ্র করে ‘আকিকা' নামক বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করে। ‘খতনা’ মুসলমান সমাজের একটি অতি পরিচিত সামাজিক প্রথা ছিল । বিয়ে মুসলমান সমাজের একটি বিশেষ উৎসবমুখর অনুষ্ঠান । মৌলবিরা মুসলমান রীতি-নীতি অনুযায়ী বিবাহকার্য সম্পন্ন করে থাকেন। মৃতদেহ সৎকার এবং মৃতের উদ্দেশে বিভিন্ন সময়ে মুসলমানরা কতকগুলো ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতি পালন করে। তারা মৃতদেহকে কবর দেয় এবং তার আত্মার শান্তির জন্য কোরআন পাঠ করে এবং মিলাদ পড়ায় । ধর্মীয় উৎসবাদি এবং বিয়ে-শাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানে মৌলবিদের উপস্থিতি অপরিহার্য । মুসলমান সমাজে সুফি ও দরবেশ নামে পরিচিত পির বা ফকির সম্প্রদায়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য সাধারণ মানুষ তাদের দেয়া তাবিজ-কবজ ব্যবহার করত । বাংলার বিশাল সংখ্যক হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। ধর্মান্তরিত ব্যক্তিরা অনেকেই তাদের পূর্ববর্তী ধর্মের কোনো কোনো বিশ্বাস ও সংস্কার ত্যাগ করতে পারেনি। এভাবে হিন্দু সমাজের ‘গুরুবাদ’ মুসলমান সমাজে প্রবেশ করে । পিরের দরগায় সন্ধ্যায় আলো জ্বালানো এবং শিরনি প্রদান অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা ছিল ।
অভিজাত মুসলমানরা ছিল ভোজনবিলাসী। তাদের খাদ্য তালিকায় বিভিন্ন মাছ-মাংসের সঙ্গে আচারের নামও পাওয়া যায় । এসব খাবারের পাশাপাশি কাবাব, রেজালা, কোর্মা আর ঘিয়ে রান্না করা যাবতীয় মুখরোচক খাবার জায়গা করে নেয় । ভাত, মাছ, শাক-সবজি বাঙালি মুসলমানদের প্রতিদিনের খাদ্য ছিল। খাদ্য হিসেবে রুটির ব্যবহারের কথাও জানা যায় । খিচুড়ি তখনকার সমাজে একটি প্রিয় খাদ্য ছিল । অভিজাত মুসলমানরা পায়জামা ও গোল গলাবন্ধসহ জামা পরত। তাদের মাথায় থাকত পাগড়ি, পায়ে থাকত রেশম ও সোনার সুতার কাজ করা চামড়ার জুতা । তারা তাদের আঙ্গুলে অনেক মণি-মুক্তা বসানো আংটি ব্যবহার করত । মোল্লা ও মৌলবিরাও পায়জামা, জামা এবং টুপি ব্যবহার করত। গরিব বা নিম্ন শ্রেণির মুসলমানরা লুঙ্গি ও টুপি পরত। অভিজাত মহিলারা কামিজ ও সালোয়ার ব্যবহার করত । তারা প্রসাধনী ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল না । তারা বাহু ও কব্জিতে সোনার অলঙ্কার এবং আঙ্গুলে সোনার আংটি পরত ।
এ যুগের প্রথম দিকে চারিত্রিক গুণাবলি ও সততার জন্য মুসলমানরা বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিল । পরবর্তী সময়ে তারা ধর্মীয় আচরণের ক্ষেত্রে কঠোর ও নৈতিক মান বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে মুসলমান সমাজে দুর্নীতি ও অনৈসলামিক কার্যাবলির অনুপ্রবেশ ঘটে। সামাজিক জীবনে মুসলমানদের নৈতিক অধঃপতন শাসন ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করেছিল । বাংলার নবাবি শাসনের অবসানের পেছনে শাসকবর্গের নৈতিক অবনতি যথেষ্ট দায়ী ছিল।
হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতি:
মধ্যযুগে বাংলার মুসলমানদের প্রভাব, রীতিনীতি ও ভাবধারা হিন্দু সমাজে অনুপ্রবেশ করেছিল । তথাপি হিন্দু সমাজের মূল নীতিগুলো এবং সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ যুগেও হিন্দু সমাজে জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল । বিভিন্ন পেশাকে ভিত্তি করেই এ প্রথার সৃষ্টি। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র সমাজে এ চারটি উল্লেখযোগ্য বর্ণ ছিল । এ চার বর্ণের মানুষের মধ্যে সামাজিক মেলামেশা ছিল না। বর্ণপ্রথা কঠোরভাবে পালিত হতো । ফলে এক বর্ণের সঙ্গে অন্য বর্ণের বিয়ে বা আদান-প্রদান নিষিদ্ধ ছিল । ধর্মকর্মের ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের একক কর্তৃত্ব ছিল।
মধ্যযুগের বাংলায় জন্ম, বিয়ে ও মৃত্যু উপলক্ষে হিন্দুরা বিভিন্ন সামাজিক রীতি-নীতি পালন করতো । তখনকার যুগের প্রচলিত অনুষ্ঠানগুলো বর্তমানকালেও রক্ষণশীল হিন্দু সমাজে লক্ষ্য করা যায়। সন্তান জন্মের পর তাকে গঙ্গাজল দিয়ে ধৌত করা হতো । ষষ্ঠ দিনে ষষ্ঠী পূজার আয়োজন করা হতো। ব্রাহ্মণ শিশুর কোষ্ঠী গণনা করতেন । এক মাস পর বালক উত্থান পর্ব পালন করা হতো। ছয় মাসের সময় করা হতো অন্নপ্রাশনের ব্যবস্থা । অধিকাংশ হিন্দু রমণী নিয়মিত উপবাস ও একাদশী পালন করতো।
হিন্দু সমাজে বিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক অনুষ্ঠান। বাংলায় হিন্দু সমাজে একান্নবর্তী পরিবারই ছিল অধিক । পিতার মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্রই সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করত। স্বামীভক্তি হিন্দু সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল।
এ সময়ে বাংলার হিন্দু সমাজে নারীদের তেমন কোনো অধিকার ছিল না। স্বামী স্ত্রীকে তার সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করত। কন্যা মাতা-পিতার ওপর, স্ত্রী স্বামীর ওপর, বিধবারা সন্তানদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্পত্তির ওপর স্ত্রীদের কোনো অধিকার ছিল না। সমাজে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল । তবে বাংলায় সর্বত্র এ প্রথা বাধ্যতামূলক ছিল না । তথাপি এ যুগে অনেক নারী নিজ যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নিজেদের স্বাধীন সত্তাকে বিকশিত করতে সমর্থ হয়েছিল । সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এ যুগের নারীদের কৃতিত্ব কম ছিল না । বিত্তশালী পরিবারে নিয়মিত শিল্প ও সংস্কৃতির চর্চা হতো । বীণা, তানপুরা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রে এ যুগের নারীরা পারদর্শী ছিল ।
পোশাক ও অলঙ্কার হিসেবে মেয়েরা পাট ও তুলার কাপড়, আংটি, হার, নাকপাশা, দুল, সোনার ব্রেসলেট, সোনার শাঁখা, কানবালা, নথ, অনন্ত, বাজু প্রভৃতি ব্যবহার করতো। বিত্তবান নারীরা অলঙ্কার ব্যবহার করতো। এ সকল অলঙ্কার সোনা, রুপা, হাতির দাঁত দ্বারা নির্মিত হতো এবং মণিমাণিক্য খচিত থাকতো । বিবাহিত স্ত্রীলোকেরা প্রসাধনী হিসেবে সিঁদুর, কাজল, চন্দন মিশ্রিত কস্তুরী প্রভৃতি ব্যবহার করতো। অনেকে পায়ে নূপুর পরতো। কেবল বিশেষ অনুষ্ঠানে এ সকল অলঙ্কার ও প্রসাধনী ব্যবহার করা হতো। সাধারণ মেয়েরা নিজেদের গৃহে সাধারণ বেশভূষায় সজ্জিত থাকতো। শাড়ি তাদের নিত্যদিনের পোশাক ছিল। পুরুষদের সাধারণ পোশাক ছিল ধুতি । অভিজাত এবং শিক্ষিত ব্যক্তিরা চাদর ও পাগড়ি ব্যবহার করতো। ধনী ব্যক্তিরা বিশেষত ব্যবসায়ীরা গলায় হার, কানে দুল এবং আঙ্গুলে আংটি পরতো।
মধ্যযুগের বাংলার হিন্দু সমাজের খাদ্যের সঙ্গে বর্তমান হিন্দু সমাজের খাদ্যের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই । ভাত ছিল প্রধান খাদ্য। এছাড়া খাদ্য তালিকায় ছিল মাছ, মাংস, শাক-সবজি, দুধ, দধি, ঘৃত, ক্ষীর ইত্যাদি। চাল থেকে প্রস্তুত নানা প্রকার পিঠাও জনপ্রিয় মুখরোচক খাবার ছিল। বাঙালি ব্রাহ্মণরা আমিষ খেত । তখন সকল প্রকার মাছ পাওয়া যেত । পূর্ববঙ্গে ইলিশ ও শুঁটকি মাছ খুব প্রিয় খাবার ছিল । তরকারির মধ্যে বেগুন, লাউ, কুমড়া, ঝিঙ্গা, কাঁকরোল, কচু উৎপন্ন হতো। ফলের মধ্যে আম, কাঁঠাল, কলা, তাল, পেঁপে, নারকেল, ইক্ষু পাওয়া যেত। উল্লেখ্য, তখনকার সময়ে হিন্দু-মুসলমানদের খাদ্য তালিকার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না। তবে গরুর মাংস খাওয়া হিন্দুদের নিকট চরম অধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতো ।
হিন্দু সমাজে কৌলীন্য প্রথা প্রচলিত ছিল । ফলে সমাজে নানা অনাচার অনুপ্রবেশ করেছিল । ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের মধ্যে এ প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল । কৌলীন্য প্রথার ফলে সমাজে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত হয় । মধ্যযুগে বাংলায় হিন্দু ও মুসলমান সমাজ জীবনে কতকগুলো সামাজিক বিশ্বাস জন্মলাভ করেছিল । জ্যোতিষী পাঁজি-পুঁথি ঘেঁটে শুভক্ষণ নির্ধারণ করত। এ সময় জনগণ ইন্দ্রজাল এবং জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করতো।
নদীমাতৃক বাংলার ভূমি চিরদিনই প্রকৃতির অকৃপণ আশীর্বাদে পরিপুষ্ট । এখানকার কৃষিভূমি বেশ উর্বর। মধ্যযুগে এখানকার উৎপন্ন ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ধান, গম, তুলা, ইক্ষু, পাট, আদা, জোয়ার, তিল, শিম, সরিষা ও ডাল। কৃষিজাত দ্রব্যের মধ্যে পিঁয়াজ, রসুন, হলুদ, শশা প্রভৃতি ছিল উল্লেখযোগ্য । আম, কাঁঠাল, কলা, মোসাব্বর, খেজুর ইত্যাদি ফলমূলের ফলনও ছিল প্রচুর। পান, সুপারি, নারকেলও প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হতো । গালা বা দ্রাক্ষাও উৎপন্ন হতো প্রচুর । মুসলমান শাসনের সময় থেকেই বাংলায় পাট ও রেশমের চাষ শুরু হয়।
বাংলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মূল উৎস ছিল কৃষি । কৃষি ফলনের প্রাচুর্য থাকলেও এ সময়ের চাষাবাদ পদ্ধতি ছিল অনুন্নত । আধুনিক সময়ের মতো পানি সেচ ব্যবস্থা সে যুগে ছিল না । কৃষককে অধিকাংশ সময়েই সেচের জন্য বৃষ্টির ওপর নির্ভর করতে হতো। কৃষিপ্রধান দেশ বলে বাংলার অধিবাসীর বৃহত্তর অংশ ছিল কৃষক । বাংলার মাটিতে কৃষিজাত দ্রব্যের প্রাচুর্য ছিল । ফলে উদ্বৃত্ত বিভিন্ন পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হতো। এ ব্যবসায়িক তৎপরতা কালক্রমে শিল্পের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়। মুসলমান শাসনকালে বঙ্গে বস্ত্র শিল্প, চিনি শিল্প, নৌকা নির্মাণ কারখানা ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল ।
বস্ত্র শিল্পে বাংলার অগ্রগতি ছিল সবিশেষ উল্লেখযোগ্য । এখানকার নির্মিত বস্ত্রগুলো গুণ ও মানের বিচারে যথেষ্ট উন্নত ছিল । তাই বিদেশে এগুলোর প্রচুর চাহিদা ছিল। নিজেদের ব্যবহারের জন্য রঙিন কাপড় এবং বিদেশে রপ্তানি করার জন্য সাদা কাপড় এখানে তৈরি করা হতো। ঢাকা ছিল মসলিন নামক বিশ্বখ্যাত সূক্ষ্ম বস্ত্র শিল্পের প্রধান প্রাণকেন্দ্র। ইউরোপে এর প্রচুর চাহিদা ছিল। এ বস্ত্র এত সূক্ষ্ম ছিল যে, ২০ গজ মসলিন একটি নস্যির কৌটায় ভরে রাখা যেত। পাট ও রেশমের তৈরি বস্ত্রেও বাংলার কৃতিত্ব ছিল উল্লেখযোগ্য । বাংলায় চিনি ও গুড় তৈরি এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে ।
মধ্যযুগে বাংলার রকমারি ক্ষুদ্র শিল্পের কথা জানা যায়। এ প্রসঙ্গে ধাতব শিল্পের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । তখন লৌহ নির্মিত দ্রব্যাদির ব্যাপক প্রচলন ছিল । কর্মকারগণ বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি নির্মাণ করত । এছাড়া দু'ধারী তরবারি, ছুরি, কাঁচি, কোদাল ইত্যাদি নিত্যব্যবহার্য ধাতব দ্রব্য তৈরি হতো । কলকাতা ও কাশিম বাজারে এদেশের লোকেরা কামান তৈরি করত । কাগজ, গালিচা, ইস্পাত প্রভৃতি শিল্পের কথাও জানা যায় । বঙ্গের অন্যতম শিল্প হিসেবে লবণের কথাও জানা যায় । দেশে স্বর্ণকার সম্প্রদায় ছিল । বাঙালি কারিগরেরা স্বর্ণ, রৌপ্য, ব্রোঞ্জ, কাঠ, পাথর, গজদন্ত ইত্যাদির কাজ বিশেষ নিপুণতার সঙ্গে সম্পাদন করত । শঙ্খ শিল্পের জন্য ঢাকার প্রচুর সুখ্যাতি ছিল । ঢাকার শাঁখারীপট্টি আজও সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয় ।
রপ্তানি দ্রব্য:
বাংলার কৃষি ও শিল্প পণ্যের প্রাচুর্য এবং বিদেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদার ফলে বিদেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যিক তৎপরতা মুসলমান শাসন আমলে অভূতপূর্ব প্রসার লাভ করেছিল । বাংলার রপ্তানি পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সুতি কাপড়, মসলিন, রেশমি বস্ত্র, চাল, চিনি, গুড়, আদা, লঙ্কা ইত্যাদি । কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে চাল, তামাক, সুপারি, পাট, ফল ইত্যাদি রপ্তানি হতো । বিবিধ কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্য ছাড়াও বাংলা থেকে লবণ, গালা, আফিম, নানা প্রকার মসলা, ঔষধ ইত্যাদি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে এবং বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো । তখন বাংলায় দাস ব্যবসাও প্রচলিত ছিল ।
আমদানি দ্রব্য:
ব্যবসা-বাণিজ্যের সিংহভাগই ছিল রপ্তানি নির্ভর। খুব অল্প পরিমাণ দ্রব্য আমদানি করা হতো । বাংলার কাপড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় কাঁচামাল হিসেবে তুলা আমদানি করা হতো। বাঙালি বণিকেরা গুজরাট থেকে আমদানি করত তুলা, চীন থেকে রেশম, ইরান থেকে শৌখিন দ্রব্য। এছাড়া বাংলায় আমদানি করা হতো স্বর্ণ, রৌপ্য ও মূল্যবান পাথর ।
বন্দর:
মুসলমান শাসনের সময় বাংলায় বেশ কিছু সমুদ্রবন্দর ও নদীবন্দর গড়ে উঠেছিল। চট্টগ্রাম ছিল তখনকার বিখ্যাত সমুদ্রবন্দর। উড়িষ্যা, সোনারগাঁ, গৌড়, বাকলা (বরিশাল), মুর্শিদাবাদ, কাশিমবাজার, হুগলি, বিহারের পাটনা ও উড়িষ্যার পিপলী উল্লেখযোগ্য বাণিজ্যবন্দর ছিল । ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে দ্রব্য ও টাকা-পয়সার লেনদেন এবং হিসাব-নিকাশ বৃদ্ধি পায় । তাই ক্রমে ব্যাংকিং প্রথার বিকাশ ঘটে । এ যুগে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে লেনদেন করা হতো। সমগ্র মধ্যযুগে বাংলায় দ্রব্যসামগ্রী সহজলভ্য ও সস্তা ছিল। চৌদ্দ শতকে বিখ্যাত ভ্রমণকারী ইবনে বতুতা লিখেছেন যে, সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাংলাতেই সবচেয়ে সস্তায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত । তারপরও সমসাময়িক সাহিত্য থেকে জানা যায়, দেশে ঐশ্বর্যশালী ধনীর পাশাপাশি প্রচুর দরিদ্র লোকও ছিল। তাই দ্রব্যসামগ্রী সস্তা হলেও তা সাধারণ কৃষক ও প্রজাদের সহজে কেনার সামর্থ্য ছিল না । বাংলার শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মুসলমান অপেক্ষা হিন্দুদের প্রাধান্য ছিল বেশি। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কোনো কর্তৃত্ব ছিল না। এদেশের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত আরবীয় ও পারসিক বপিকেরা। নৌ-বাণিজ্যের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল তাদেরই। পরবর্তীকালে পর্তুগিজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা ব্যবসার ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে।
মুসলমান শাসকগণ ইসলামের গৌরবকে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং নিজেদের শাসনকালকে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে অনেক প্রাসাদ, মসজিদ, কবর, দরপাহ ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদ নির্মাণকে মুসলমান শাসকগণ অভিলয় পুণ্যের কাজ বলে বিবেচনা করতেন। সুলতানি আমলের স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে এখনও অনেক স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।
স্বাধীন বাংলার মুসলমান সুলতানদের রাজধানী প্রথমে ছিল গৌড়, পরে পাওয়া এবং এরপর আবার গৌড়। কাজেই এ দুই শহরেই প্রথমে মুসলিম ঐতিহ্যের স্থাপত্য নিদর্শन উঠেছিল। ১৩৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সিকান্দার শাহ 'আদিনা মসজিদ' নির্মাণ করেন। এ মসজিদের উত্তর পাশে সিকান্দার শাহের কবর নির্মিত হয়েছিল।
বৰ্তমান ঢাকা থেকে ১৫ মাইল দূরে সোনারগারে গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের একটি কবর আছে। এ কবরের অতি নিকটে পাঁচটি দরগাহ ও পাঁচটি মসজিদ আছে। এগুলো 'পাঁচ পীরের দরগাহ' নামে পরিচিত।
সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি স্থাপত্যকলার একটি সুন্দর নিদর্শন। সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনকালের উল্লেখযোগ্য কীৰ্ত্তি পাণ্ডুয়ার 'এক লাখি মসজিদ'। এর নির্মাণকাল ১৪১৮-১৪২৩ খ্রিষ্টাব্দ। প্রবাদ আছে যে, তখনকার দিনে এক লখ টাকা ব্যয়ে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তাই এটি 'এক লাখি মসজিদ' নামে পরিচিত হয়েছে। এ মসজিদ আসলে একটি কবর। এ সমাধি সৌধে তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্রদের সমাহিত করা হয়।
বড় সোনামসজিদের আর এক নাম 'বারদুয়ারি মসজিদ'। এতে বৃহৎ বারোটি দরজা ছিল। এ মসজিদে সোনালি রঙের গিলটি করা কারুকার্য ছিল। সম্ভবত এজন্যই এটি সোনা মসজিদ নামে অভিহিত হতো। এ মসজিদটি গৌড়ের বৃহত্তম ম । আসাম বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য হুসেন শাহ এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৫২৭ খ্রিষ্টান্সে নসরত শাহ এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন।
গৌড় শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বর্তমান ফিরোজাবাদ গ্রামে 'ছোট সোনামসজিদ' নির্মিত হয়েছিল। এ মসজিদটি ছিল আকারে ছোট। তবে এ মসজিদেও সোনালি রঙের গিলটির কারুকার্য ছিল। সম্ভবত এ কারণেই এটি ছোট সোনামসজিদ নামে পরিচিত। আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে জনৈক ওয়ালি মুহম্মদ এটির নির্মাতা ছিলেন।
বাগেরহাট জেলায় খান জাহান আলীর সমাধি নির্মিত হয়েছে। কিংবদন্তি অনুসারে খান জাহান আলী নামক জনৈক পির ঐ স্থানে বসতি স্থাপন করেন। ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি সুলতান নাসিরউদ্দীনের সমসাময়িক ছিলেন।
বাগেরহাট জেলার ‘ষাটগম্বুজ মসজিদ' বাংলার মুসলমান শাসনকালের গৌরব বৃদ্ধি করেছে। খান জাহান আলীর সমাধির তিন মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে ষাটগম্বুজ মসজিদ অবস্থিত। অবশ্য এর গম্বুজ বাটটি নয়, সাতাত্তরটি। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়েছিল। তুর্কি সেনাপতি ও ইসলামের একনিষ্ঠ সাধক উলুখ খান জাহান এ afer নির্মাণ করেন। এই স্থাপত্য কর্মটি জাতিসংগের ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্বসভ্যতার নিদর্শন হিসেবে (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) স্বীকৃত হয়েছে।
'কদম রসুল পৌড়ে অবস্থিত। মহানবির পদচিহ্নের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ ভবনটি নির্মিত হয়। নসরত শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন (১৫৩১ খ্রিষ্টাব্দ)। এ ভবনের এক কক্ষে একটি কালো কারুকার্যখচিত মর্মর বেদির উপরে হযরত মুহম্মদ (স) এর পদচিহ্ন সংবলিত একখণ্ড প্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল।
ঢাকা জেলার রামপালে 'বাবা আদমের মসজিদ' অবস্থিত। ১৪৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মালিক কাফুর ফতেহ শাহের রাজত্বকালে এটি নির্মিত হয়। এগুলোর বাইরেও বাংলার নানা স্থানে বহু মসজিদ ও সমাধি সৌধ আছে।
মসজিদ ও সমাধি সৌধ ছাড়াও এ যুগের নির্মিত বিভিন্ন তোরণ-কক্ষ ও মিনার মুসলমান বাংলার স্থাপত্য শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এদের মধ্যে রুকনউদ্দিন বরবক শাহ নির্মিত গৌড়ের 'দাখিল দরওয়াজা' ও আলাউদ্দিন হুসেন শাহের সমাধি-তোরণ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। গৌড়ের 'ফিরোজ মিনার' স্থাপত্য শিল্পের আর একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। অনেকে মনে করেন যে, যাৰসি সুলতান সাইফউদ্দিন ফিরোজ শাহ এটি নির্মাণ করেছিলেন।
মুঘল আমলে বাংলার শাসকগণ শিল্পকলার ক্ষেত্রে এক বিস্ময়কর অবদান রেখে গেছেন। আজও বাংলার বহু স্থাে মুঘল শাসকগণের শিল্পপ্রীতির নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু মসজিদ, সমাধি ভবন, স্মৃতিসৌধ, মাজার, দুর্গ, স্তম্ভ ও তোরণ নির্মিত হয়েছিল। স্থাপত্য শিল্পের বিকাশের জন্য এ যুগকে বাংলার মুঘলদের 'স্বর্ণযুগ' হিসেবে অভিহিত করা হয়।
মুঘল যুগে 'কাটরা' নামে বেশ ক'টি দালান তৈরি করা হয়েছিল। এগুলো ছিল অতিথিশালা। ঢাকার বড় কাটরা' নির্মাণ করেন শাহ সুজা। এটি চকের দক্ষিণ দিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত।
নারায়ণগঞ্জ জেলার শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হাজিগঞ্জ দুর্গ (বর্তমানে খিজিরপুর দুর্গ নামে পরিচিতি) সম্ভবত সুবাদার মির জুমলা (১৬৬০ - ১৬৬৩ খ্রিষ্টাব্দ) এটি নির্মাণ করেন। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এ দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল।
সুবাদার শাহজাদা আজম বেশ কিছু ইমারত তৈরি করেছিলেন। বুড়িগঙ্গার তীরঘেঁষে তিনি এক বিশাল কাটরা তৈরি করেছিলেন। তাঁর আমলেই 'লালবাগের শাহি মসজিদ তৈরি হয় ।
বাংলায় মুঘল শিল্পকলার বিস্তারের ক্ষেত্রে শায়েস্তা খানের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৬৬৩ খ্রিস্টাব্দে শায়েস্তা খান ছোট কাটরা নির্মাণ করেন। এটি বড় কাটরা থেকে ২০০ গজ দূরে অবস্থিত । লালবাগের কেন্দ্রা আজও শায়েস্তা খানের শাসনকালকে স্মরণ করিয়ে দেয় । তাঁর শাসনকালের পূর্বেই এর নির্মাণ কাজ ত হয়। তিনি এটি শেষ করার পদক্ষেপ নেন। ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে ইব্রাহিম খানের শাসনকালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। লালবাগ দুর্গের ভেতর রয়েছে শায়েস্তা খানের কন্যা বিবি পরির সমাধি- সৌধ'। মার্বেল পাথরে নির্মিত এ সমাধি ভবনটি এখন পর্যন্ত এদেশে সর্বাধিক সুন্দর মুসলিম স্মৃতিসৌধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ১৬৭৬ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খান হোসেনী দালান নির্মাণ করেন । চকবাজারের মসজিদ, বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত শায়েস্তা খানের মসজিদ ও সাতগম্বুজ মসজিদের সাথে শায়েস্তা খানের নাম জড়িয়ে আছে।
বাংলার নবাবদের সময়েও বহু ইমারত নির্মিত হয়। জিনজিরা প্রাসাদ তাঁদেরই কীর্তি। মুর্শিদ কুলি খানের আমলে বেগম বাজার মসজিদ নির্মিত হয় । মুর্শিদাবাদে তিনি একটি কাটরা ও মসজিদ নির্মাণ করেন। চেহেল ‘সেতুন' নামে একটি প্রাসাদও তাঁর সময়ে তৈরি। এটি ছিল একটি প্রকাণ্ড দরবার ভবন। এ সবান্ত স্থাপনা ছাড়াও মুঘল আমলে অনেক দুৰ্গ, ঈদগাহ, হাম্মামখানা, চিল্লাখানা ও সেতু নির্মাণ করা হয়। মুঘল যুগের এ সকল শিল্পকীর্তি বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বর্তমানকালের মতো সে যুগেও হিন্দুরা বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার-অনুষ্ঠান পালন করতো। আড়ম্বর ও জাঁকজমকের সঙ্গে হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজা করতো। এর মধ্যে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, শিব, শিবলিঙ্গ, চণ্ডী, মনসা, বিষ্ণু, কৃষ্ণ, সূর্য, মদন, নারায়ণ, ব্রহ্ম, অগ্নি, শীতলা, ষষ্ঠী, গঙ্গা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য । বাঙালি হিন্দুরা সামাজিক জীবনে দুর্গাপূজা, দশহরা, গঙ্গা স্নান, অষ্টমী স্নান এবং মাঘী সপ্তমী স্নানকে পবিত্র বলে মনে করতো। ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের নিকট গঙ্গাজল অত্যন্ত পবিত্র। তারা দোলযাত্রা, রথযাত্রা, হোলি ইত্যাদি ধৰ্মীয় উৎসব পালন করতো। ধর্মীয় ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় প্রাচীন বাংলার সময়ের ন্যায় এ যুগেও অপরিসীম কর্তৃত্বের অধিকারী ছিল। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা ধর্ম-কর্ম পরিচালনার সার্বিক দায়িত্ব পালন করতেন।
জাতিগত শ্রেণিভেদ ছাড়াও হিন্দু সমাজে কতকগুলো ধর্মীয় সম্প্রদায় ছিল। যেমন- শৈব, শাক্ত ইত্যাদি। হিন্দু জাতির মধ্যে এ সময় বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য ছিল। এ সময়ে হিন্দু সমাজের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। মুসলমানরা বর্তমান সময়ের মতোই মধ্যযুগেও বিভিন্ন ধর্মীয় রীতি-নীতি ও আচার অনুষ্ঠান পালন করতো। ঈদ- উল-ফিতর ও ঈদ-উল-আজহা মুসলমান সমাজের প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালিত হতো। ধর্মপ্রাণ মুসলমান মাত্রই পবিত্র রমজান মাসে রোজা রাখতো। এছাড়াও শব-ই-বরাত ও শব-ই-কদরের রাতে ইবাদত-বন্দেগি করতো। উৎসব অনুষ্ঠানে মুসলমানরা তাদের সাধ্যমতো নতুন এবং পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে একে অন্যের গৃহে গিয়ে কুশল ও দাওয়াত বিনিময়ের মাধ্যমে তাদের সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্বভাবকে সুদৃঢ় করতো । সুলতান, সুবাদার ও নবাবগণ ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে জনগণের সান্নিধ্যে আসতেন। বিশেষ আড়ম্বরের সঙ্গে মুসলমানরা মহানবির (সা.) জন্মদিন পালন করতো। বর্তমান সময়ের মতো মধ্যযুগেও মহরম উৎসব পালিত হতো। এটি শিয়া সম্প্রদায়ের একটি প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলে পরিচিত। এ উদ্দেশ্যে শিয়ারা 'তাজিয়া' তৈরি করত। মুসলমানদের বর্ষপঞ্জি অনুসারে মহরমের প্রথম দিনকে নববর্ষ হিসেবে পালন করা হয় । মহরমের চন্দ্র উদয়কে মুসলমানরা আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে বরণ করত ।
এ যুগে ধর্মপ্রীতি মুসলমান সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল । ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো। এছাড়া তারা নিয়মিত কোরআন ও হাদিস পাঠ করতো। সমাজে ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। ছেলে-মেয়ে উভয়কেই ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণের জন্য মক্তবে পাঠানো হতো। সমাজে ধর্মীয় জ্ঞানের জন্য এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনার জন্য মোল্লা সম্প্রদায়কে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো । গ্রামীণ জীবনে ধর্মীয় উৎসব এবং বিয়েশাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে মোল্লা সম্প্রদায়ের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য ।
মুসলমান সমাজে সুফি ও দরবেশ নামে পরিচিত পির বা ফকির সম্প্রদায়ের যথেষ্ট প্রভাব ছিল । তাঁরা ধর্মশাস্ত্রে সুপণ্ডিত ছিলেন এবং সর্বদা আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন থাকতেন । দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁরা ধর্ম সাধনার জন্য ‘দরগা' প্রতিষ্ঠা করেন । শাসকবর্গ ও জনগণ সকলের কাছেই তাঁরা শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। বাংলায় ইসলামের বিস্তৃতির সাথে সাথে মুসলমান সমাজও বিস্তৃত হতে থাকে। বাংলায় মুসলমান সমাজে দুইটি পৃথক শ্রেণি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। একটি বিদেশ থেকে আগত মুসলমান, অন্যটি স্থানীয় ভাবে ধর্মান্তরিত মুসলমান। বিদেশি ও স্থানীয় মুসলমানদের মধ্যে কৃষ্টি ও রীতিনীতির পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দেয়নি। মুসলমান শাসকদের উদারতা এবং স্থানীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রতি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতাই এর কারণ ছিল ।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ও উন্নতির জন্য সুলতানি ও মুঘল শাসনকালের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এ বিষয়ে প্রথমেই যাঁর নাম উল্লেখ করা প্রয়োজন তিনি হলেন ইলিয়াস শাহি বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৯৩-১৪১১ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর শাসনকালেই প্রথম বাঙালি মুসলমান কবি শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর প্রণয়মূলক কাব্য 'ইউসুফ-জুলেখা' রচনা করেন। এটি ফার্সি রচনার অনুবাদ । সুলতানি যুগে আরও কয়েকজন কবি ফার্সি কাব্যের অনুবাদ করেছেন। তাঁদের মধ্যে দৌলত উজির বাহরাম খান ও দোনা গাজীর নাম উল্লেখযোগ্য ।
বাংলা ভাষায় ঐতিহাসিক সাহিত্য রচনার পথপ্রদর্শক হিসেবে মুসলমানদের অবদান অবিস্মরণীয় । ইসলামের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক মুসলমান কবি বিজয়কাব্য রচনা করেছেন । বিজয়কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেন ‘রসুল বিজয়' কাব্য রচয়িতা জয়নুদ্দীন । বাংলার মুসলমান কবিরা পদাবলি রচনা করেন। চাঁদ কাজী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম পদাবলি কাব্যের স্রষ্টা। পিরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে এ যুগে মুসলমান কবিরা অনেক কাব্য বাংলায় রচনা করেন। বাংলা ভাষায় মুসলমানরা সঙ্গীতবিদ্যার চর্চাও করেছিলেন । বাংলা সাহিত্যে সঙ্গীতবিদ্যার ওপর রচিত প্রথম গ্রন্থ 'রাগমালা' রচনা করেছিলেন কবি ফয়জুল্লাহ্ । কবি মোজাম্মেল ‘নীতিশাস্ত্র বার্তা' ও ‘সাতনামা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন ।
বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি ও সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও মুসলমান কবিদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে । বহু আরবি ও ফার্সি শব্দ তাঁরা বাংলা ভাষায় ব্যবহার করেছেন । আল্লাহ, খোদা, নবি, পয়গম্বর, কিতাব ইত্যাদি বহু শব্দ সে সময়ের মুসলমান কবি-লেখকদের ব্যবহারের ফলে বাংলা শব্দভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে । সুলতানি যুগে হিন্দু কবিরাও সাহিত্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। এক্ষেত্রে মুসলমান শাসকবর্গের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা হিন্দু কবি-সাহিত্যিকদের বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছে । বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ও বিকাশ হুসেন শাহের শাসনকালকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তাঁর উদার পৃষ্ঠপোষকতা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি সাধন করেছে। এ যুগের বিখ্যাত কবি ও লেখকগণের মধ্যে রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, মালাধর বসু, বিজয়গুপ্ত, বিপ্রদাস ও যশোরাজ খান উল্লেখযোগ্য ছিলেন। এ সময়ে মালাধর বসু ‘শ্রীমঙ্গবাদ’ও ‘পুরাণ’ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন । সুলতান হুসেন শাহ ও নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘মহাভারত’ বাংলায় অনুবাদ করেন ।
বৈষ্ণব কবি হিসেবে বৃন্দাবন দাসের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষায় তিনিই সর্বপ্রথম শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনচরিত গ্রন্থ 'চৈতন্য-ভগবত' রচনা করেন । চন্দ্রাবতী ‘মনসা মঙ্গল' কাব্য রচনা করেছিলেন । সংস্কৃত সাহিত্যেও মুসলমান সুলতানগণের যথেষ্ট অবদান ছিল। সংস্কৃত ভাষার সাথে বাংলা ভাষার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এজন্য অনেক মুসলমান শাসক এর প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাঁদের অনেকে ব্যক্তিগতভাবে সংস্কৃত ভাষার চর্চাও করতেন । মুসলমান শাসনকালে বাংলা সংস্কৃত সাহিত্যের এক বিরাট কেন্দ্র ছিল । শুধু বাংলা ও সংস্কৃতই নয়, আরবি ও ফার্সি কাব্যের চর্চাও সুলতানি যুগে ছিল । মুঘল যুগে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট উন্নতি লক্ষ্য করা যায়। তবে মুঘল শাসকগণ সুলতানি যুগের শাসকদের মতো ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কোনো সহযোগিতা করেননি। বাংলার জমিদারগণ স্বীয় প্রচেষ্টায় সে ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন ।
মুসলমান যুগে প্রতিবেশী আরাকানের সঙ্গে বাংলার রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল । ফলে আরাকানে বাংলা সাহিত্যের প্রসার ঘটতে শুরু করে । আরাকান রাজসভার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন দৌলত কাজী। আলাওল ছিলেন রাজসভার আর একজন কবি । তাঁর ছয়টি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে 'পদ্মাবতী' সর্বশ্রেষ্ঠ । তিনি কয়েকটি ফার্সি কাব্যগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেন । এছাড়া, ‘রাগনামা' নামে একটি সঙ্গীতশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থও তিনি রচনা করেছিলেন । বাহরাম খান রচনা করেন 'লাইলী-মজনু' কাব্যগ্রন্থ । 'জঙ্গনামা' ও 'হিতজ্ঞান বাণী' গ্রন্থগুলো কবি কাজী হায়াৎ মাহমুদ রচিত । কবি শাহ গরীবুল্লাহ ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ পুঁথি সাহিত্যিক ।
বাংলার মুসলমান শাসকগণ কেবল রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন । বাংলায় মুসলমান শাসনকালে শিক্ষার দ্বার হিন্দু-মুসলমান সকলের জন্য উন্মুক্ত ছিল । শেখদের খানকাহ্ ও উলেমাদের গৃহ শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল । মুসলমান শাসনের সময় বাংলার সর্বত্র অসংখ্য মসজিদ নির্মিত হয়েছিল । এ সকল মসজিদের সঙ্গেই মক্তব ও মাদ্রাসা ছিল । মক্তব ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করত । বালক-বালিকারা একত্রে মক্তব ও পাঠশালায় লেখাপড়া করত । প্রাথমিক শিক্ষা সকল মুসলমান বালক-বালিকার জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। স্ত্রী শিক্ষার বিশেষ প্রচলন ছিল না। মাধ্যমিক শিক্ষা গ্রহণ মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। ফলে সাধারণ মুসলমান মেয়েরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত ছিল । শাসকবর্গের ভাষা ছিল ফার্সি । তাই এ ভাষা প্রায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করেছিল । সরকারি চাকরি লাভের আশায় অনেক হিন্দু ফার্সি ভাষায় শিক্ষা গ্রহণ করতেন । এ যুগে বাংলা ভাষা বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করেছিল । আরবি ও ফার্সি ভাষায় অজ্ঞ সাধারণ মুসলমান যেন ইসলামের ধ্যান-ধারণা বুঝতে পারে সেজন্য অনেকেই বাংলা ভাষায় পুস্তকাদি রচনা করেন। তাঁদের রচনাবলি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
মুসলমান শাসনের পূর্বে বাংলার হিন্দু সমাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া অধিকার ছিল । মুসলমানদের শাসন-ব্যবস্থায় হিন্দু সমাজের সকল শ্রেণির জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। পাঠশালায় হিন্দু বালক-বালিকারা প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করত । গুরুর আবাসস্থল কিংবা বিত্তবানদের গৃহে পাঠশালা বসত । কখনও কখনও একই ঘরের চালার নিচে মক্তব ও পাঠশালা বসত। সকালে মুনশি মক্তবের শিক্ষার্থীদের এবং বিকালে গুরু তার ছাত্রদের পাঠশালায় শিক্ষা দান করতেন । বিত্তবান লোকেরা পাঠশালার ব্যয়ভার বাহন করতেন । হিন্দু বালক-বালিকারা একত্রে পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করত ।
ছয় বছর বয়স পর্যন্ত পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য 'টোল' ছিল । সংস্কৃত ভাষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হতো । সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার জন্য নবদ্বীপ, বর্ধমান প্রভৃতি স্থানের নাম উল্লেখ্যযোগ্য ছিল । অনেক নারী এ যুগে শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে নিজেদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন । ব্রাহ্মণদের মধ্যে একটি বিশেষ শ্রেণি সর্বদা নিজেদের জ্যোতিষশাস্ত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় নিয়োজিত থাকতো । বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও এ যুগে সমাজে জনগণের মধ্যে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি বিকাশের জন্য কতকগুলো সাধারণ পদ্ধতি প্রচলিত ছিল; যেমন- ধর্মীয় সঙ্গীত, জনপ্রিয় লোক-কাহিনি ও নাটক-গাথা ইত্যাদি ।
Read more